Tuesday, September 24, 2024

হারানো দিন ফিরে পাওয়া



প্রমথ নাথ বিশির লেখা নীল শৃগাল ইত্যাদি বইটা  মনে হয় আমি যখন স্কুলের কোনও এক গরমের ছুটিতে গিয়েছিলাম আমদের আদি বাড়ি এলাহাবাদে তখন পড়ি , আমার জেঠার ছেলে আমার চেয়ে বড় সে এলাহবাদের  লাইব্রেরি থেকে বইটা আনে l আলাহাবাদে অনেক বাঙালি,অখিল ভারত বঙ্গ সম্মেলন ওখানে হয় কোনো এক সময় l

বইটি ভাল লাগার কারণ প্রমথ বাবু যিনি একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন আর অনেক ঐতিহাসিক গল্প লেখেন l এই বইটির গল্প গুলো ইতিহাসের পাতা থেকে টুকরো টুকরো ঘটনা যেখানে ইতিহাসে আর কিছু লেখা নেই সেখানে প্রমথ বাবু নিজের কল্পনা শক্তি দিয়ে গল্প লিখেছেন l যেমন একটা গল্প হল ঐ সন্যাসীটির কি হইলো l যে সন্যাসী  কে দেখে সিদ্ধার্থ সন্যাস  নেন l ইতিহাসে কিছু নেই ঐ সন্যাসির বিষয়, কিন্তু প্রমথ বাবু কল্পনা করে সেই সন্যাসী র বিষয় গল্প লেখেন l ঐ বইটার সব গল্প ঐ ধরণের যেখানে যে সব ঐতিহাসিক চরিত্র হারিয়ে গিয়েছে l যাকে বলে যেখানে ইতিহাস শেষ সেখানে কল্পনার শুরু  l

আমি প্রতি বইমেলায় বইটার খোঁজ করি, সবাই বলে কলেজ স্ট্রীটের পুরানো বইয়ের দোকানে পেয়ে যাবেন l 

ঐ বই খুঁজ তে খুঁজ তে আমার কলেজ স্ট্রিট আসা l

কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানগুলো ঘুরতে ঘুরতে শেষমেশ একটা ছোট্ট দোকানে এসে দাঁড়ালাম। 

 দোকানের মালিক, আমার বয়সী একজন, তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। আমি বললাম আমি প্রমথনাথ বিশীর ‘নীল শৃগাল ইত্যাদি গল্প’ বইটা খুঁজছি। বললাম, “দিল্লিতে স্কুলে থাকাকালীন পড়েছিলাম বইটা।”


লোকটা শুনে যেন একটু উজ্জীবিত হয়ে উঠল। সে বলল, “আপনি দিল্লির লোক?”


“হ্যাঁ, মিন্টো রোডে ৫০-এর দশকে আর পরে গোল মার্কেটে ।”


সে একটু থেমে বলল, “আমিও তো মিন্টো রোডে থাকতাম। সাত বছর বয়সে বাবা মারা গেলে আমরা কলকাতায় চলে আসি।”


আমি তখন একটু মনযোগ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার নাম কি গোপাল?”


সে বিস্মিত হয়ে জবাব দিল, “হ্যাঁ, কিন্তু তুমি...?”


“আমি সমু। আমরা ফুটবল খেলতাম একসাথে। টুনু, তোমার কাজিন,  আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে ছিল দুর্দান্ত ফুটবলার, মনে আছে?

গোপালের চোখে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল, তারপর সে হেসে উঠল। “অবশ্যই মনে আছে! আমরা কতবার ফুটবল খেলেছি! আর মনে আছে কনট প্লেসে একসাথে হেঁটে যাওয়ার সেই দিনগুলো? রোববারে মিন্টো রোড থেকে হেঁটে কনট প্লেসে যেতাম, আর্মি ব্যান্ড বাজতো, সেই সুর পুরো কনট প্লেসের চত্বর জুড়ে প্রতিধ্বনিত হতো। আমরা ঘাসের ওপর শুয়ে থাকতাম, তারায় ভরা আকাশের নিচে।”


আমি হেসে বললাম, “আর মনে আছে, আমরা কখনো কখনো বসে বই নিয়ে আলোচনা করতাম? হেমেন্দ্রকুমার রায়, নিহার গুপ্ত—তাদের লেখা গোয়েন্দা গল্প? আমরা কল্পনা করতাম নিজেদের জয়ন্ত বা মানিকের মতো গোয়েন্দা, যারা চোর-ডাকাতের দল থেকে মালপত্র উদ্ধার করছে!”


গোপাল হেসে সাড়া দিল, “ঠিকই বলেছ! আমাদের কল্পনা ছিল দারুণ—একেকবার গোয়েন্দা, তো একেকবার ভূত ধরার অভিযান। আমাদের কল্পনার জগতে অ্যাডভেঞ্চারের কোনো শেষ ছিল না।”


এইসব কথার মাঝে হঠাৎ মনে পড়ল মিন্টো রোডের দুর্গাপুজো। বললাম, “মিন্টো রোডের দুর্গাপুজো তো আমাদের জন্য ছিল একটা বিশাল আকর্ষণ। সেই চার দিনের মজা—প্যান্ডালে দৌড়াদৌড়ি, চিনাবাদাম আর ডাল সেভ খাওয়া, বরফের রং বেরঙের গোলা, ভিগি চুরান, সাথে গোলগাপ্পা। সে এক অন্য রকম আনন্দ ছিল!”


গোপাল এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করল, যেন সেই পুরনো সময়টা আবার ফিরে দেখছে। তারপর বলল, “সত্যি, সে সময়টা ভুলে যাওয়ার নয়। পুজোর আনন্দ, বন্ধুদের সাথে দৌড়াদৌড়ি, আর ছোটখাটো খাওয়াদাওয়া—তখনকার দিনগুলো ছিল আমাদের জন্য জাদুর মতো।”


আমরা দু'জনেই কিছুক্ষণ চুপ করে স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেলাম। কলেজ স্ট্রিটের ভিড় আর ব্যস্ততা আমাদের চারপাশে থাকলেও, আমরা যেন নিজেদের পুরনো সময়ের ভেতরে ডুবে ছিলাম—সেই মায়াবী সন্ধ্যা, কনট প্লেসের সেনা ব্যান্ডের প্রতিধ্বনি, আর বন্ধুদের সাথে ভাগ করে নেওয়া অসীম কল্পনার রোমাঞ্চ।

নীল শৃগাল ইত্যাদি গল্পের বইটা সেদিন ও পাই নি তার বদলে পেয়ে গেলাম আমার শৈশবের কিছু মুহূর্ত!

No comments: