আমার গল্পের শুরুতেই বলতে চাই, আমার ইঞ্জিনিয়ারিং জীবনের সূচনা হয়েছিল ১৯৬৫ সালে, যখন আমি IIT খড়গপুর থেকে পাশ করার পর ইন্ডিয়ান অয়েল কোম্পানির গৌহাটি রিফাইনারিতে ইঞ্জিনিয়ার ট্রেইনি হিসেবে যোগ দিই। সেই সময় আমি রিফাইনারির হয়ে ফুটবল খেলতাম এবং আসামের বিভিন্ন জায়গায় ম্যাচ খেলেছি। আসামে ফুটবল তখন খুবই পপুলার ছিল, ক্রিকেট ঠিক অতোটা ছিল না!
আমাদের কলেজ জীবনে রাম বাহাদুর ছিলেন এক কিংবদন্তি। তিনি ইস্ট বেঙ্গলের হয়ে ফুটবল খেলেছেন এবং ভারতীয় দলকেও প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পঞ্চাশের শেষ দিক থেকে ষাটের দশকের শুরুর দিকে তার ক্যারিয়ার ছিল তুঙ্গে।
তাই ১৯৬৬ সালে গৌহাটি রিফাইনারির হয়ে আমরা যখন ইন্টার আপার আসাম অয়েল কোম্পানির ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে গেলাম, তখন ভাবতেই পারিনি যে শিবসাগরে ONGC দলের মুখোমুখি হতে হবে, আর তাদের কোচ হবেন স্বয়ং রাম বাহাদুর!
আপার আসামে বর্ষা লেগেই থাকে, মাঠের ঘাস লম্বা আর পিচ্ছিল। আমরা এমন মাঠে আগে কখনো খেলিনি। ফুটবলটা যেন বাউন্স করতেই চাইছিল না, কাদায় পড়ে ভারী হয়ে যাচ্ছিল। আমাদের পা আটকে যাচ্ছিল কাদায়, দৌড়াতে গিয়েও গতি তুলতে পারছিলাম না। বুট অর্ধেক কাদায় ডোবা, ক্রমশ মনে হচছে কেউ যেন পাটাকে অস্টে পৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে,সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি!
আমাদের দলে ছিল আমানুল্লা, ভক্ত বাহাদুর ছেত্রী, রেবো পোদ্দার-এর মতো দাপুটে খেলোয়াড়, যারা সন্তোষ ট্রফিতে আসামকে প্রতিনিধিত্ব করে। রেবো তো একবার আমায় দেখিয়েই বলেছিল, “এই দাগটা দেখেছিস? এটা পি. বর্মনের কামড়! বাংলার এগেইনস্ট গোল করার সময় বেচারা রাগে আমায় কামড়ে দিয়েছিল! কিন্তু আমি গোলকোরেছিলাম !”পি বর্মণ তখন বাংলার গোলকিপার !
আমাদের দল শক্তিশালী ছিল, কিন্তু রাম বাহাদুরের উপস্থিতি মানসিকভাবে চাপে রেখেছিল আমাদের। ম্যাচের সময় তিনি সারাক্ষণ মাঠের বাইরে থেকে চিৎকার করছিলেন, “এগিয়ে যা! বডি ইউজ কর! বলটা ফেলে রাখিস না!”
আমি খেলছিলাম লেফট হাফব্যাক পজিশনে। খেলার সময় আমানুল্লার সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল -, আমানুল্লা লেফট ব্যাক আর আমাদের ক্যাপ্টেন !
আমি বললাম, "এ কেমন মাঠ রে! পা তো ঠিকমতো তুলতেই পারছি না।"
আমানুল্লা মাথা নেড়ে বলল, "হ্যাঁ রে, বলটাও বাউন্স করছে না। মনে হচ্ছে যেন ভিজে পাটের বস্তা নিয়ে খেলছি!"
আমি হাসতে হাসতে বললাম, "একটু কাদায় পড়লেই মনে হচ্ছে কেউ শেকল দিয়ে পা আটকে দিয়েছে!"
আমানুল্লা বলল, "আসাম টিমের ছেলেরা অভ্যস্ত, আমাদের থেকে এগিয়ে থাকবে। তবে আমাদেরও চেষ্টা করতে হবে!"
ONGC-এর ডানদিকের উইঙ্গার খুব রাফ খেলছিল। একবার সে আমার উরুতে বুটের স্পাইক ঢুকিয়ে দিল! যন্ত্রণায় আর চলতে পারলাম না, ম্যাচের মাঝেই বেরিয়ে যেতে হলো। আমার বন্ধু ভাস্করন, যে লেফট উইং-এ খেলছিল, সে অবশ্য টিকে গেল। যাই হোক, আমরা ১-০ গোলে হেরে গেলাম।
আমরা দু'জন থাকছিলাম ONGC কলোনির একটি কোয়ার্টারে কারণ টিমে আমরা দুজন ছিলাম অফিসার বাকি সব ওয়ার্কার, তাই তাদের জন্য ছিল ডরমিটরি ব্যবস্থা। ভাস্করণ এখন আর নেই ২ বছর হলো ইহলোক ছেড়ে চলে গেছে, সে আই আই টি, মদরাস থেকে পাস করে,আমার চেয়ে এক বছর সিনিয়র, খুব মিশুকে মালয়লি ছেলে !সন্ধ্যায় আমরা পুরো ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ভাস্করন তখন মুচকি হেসে বলল, “একটু OT (Old Tavern whiskey) হলে কেমন হয়?” সেই সময়ে OT খুব জনপ্রিয় ছিল। এক পেগ করে খেলাম, আর স্নান করার পর শরীর যেন পুরো শান্তি পেল।
রাতের খাবারের ব্যবস্থা ছিল ডাইনিং হলে, সবাই একসঙ্গে খাচ্ছিলাম। খাবার ছিল সাধারণ, কিন্তু স্বাদ ছিল অসাধারণ! সুগন্ধি জোহা চালের ভাত আর গরম গরম পাঁঠার মাংস! খেতে খেতে আমি বললাম, “এই খাবারটা যেন স্বর্গের মতো লাগছে রে!” জোহা হলো আসামের সর্বশ্রেষ্ঠ চাল যেমন আমাদের গোবিন্দ ভোগ কিম্বা তুলাই পাঞ্জি l
ভাস্করন হাসতে হাসতে বলল, “হ্যাঁ রে, হারার দুঃখ এই মাংস আর ভাত পুরো উড়িয়ে দিল!”
আজ এত বছর পরও সেই রাতের সেই খাবারের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। কিছু খাবারের স্বাদ মনের হার্ডডিস্কে এমনভাবে আটকে যায় যে যেকোনো সময় আমাদের মনের RAM (Random Access Memory) থেকে সহজেই তা উঠে আসে। হারার দুঃখ থাকলেও, সেই রাতের সেই খাবার যেন সমস্ত কষ্ট মুছে দিয়েছিল! আমি কিন্তু এখনও ওই এক্সপেরিয়েন্স আর কখনও পাইনি !
সেদিনের সেই কাদায় দলমল হয়ে ক্লান্ত শরীর,এক পেগ ওটি, ভালো করে স্নান আর শেষে জোহা চালের ভাত আর পাঁঠার মাংশ , জাস্ট ইউনিক!
2 comments:
Another interesting Blog from you. Now can we expect a Blog on one of your interesting site experience (technical)?
Thanks dear Abhijit!
Post a Comment