Wednesday, August 21, 2024

কাঁটা তার


আমি অন্য দিনের মত সেদিনও লেকের ধারে হাঁটছিলাম সকালে l সারা রাত বৃষ্টি পড়েছে, গাছ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ,একটু ভিজে ভিজে ভাব l হাফ প্যান্ট আর টিশার্ট এ আমি l টিশার্ট ঘামে ভেজা, বেশ জোরেই হাঁটছিলাম, পেছন থেকে কে যেন আমায় ডাকছে l

স্যার, একটু শুনবেন?

আমি ঘুরে দাঁড়ালাম, এই কুড়ি বাইশ বয়েসের এক যুবক, সাধারণ জামা কাপড়, মাঝারি হাইট l

আপনি কি,আমার নাম বললো l

হ্যাঁ,কেনো?

আপনি কি ফারাক্কায় ছিলেন,এই বিরানব্বই, তিরানব্বই সাল l

ছিলাম, কেন জিগেস করছো?

আমার দিকে একটা পুরনো মানি ব্যাগ এগিয়ে দেয় আর বলে এটা কি আপনার? এই ব্যাগে আপনার পুরনো ভিজিটিং কার্ড পেলাম, সেটা দেখে NTPC থেকে আপনার খোঁজ পাই!

ব্যাগটা হাতে নিলাম,অনেক পুরানো কথা মনে পড়ে গেল l

আমার জীবনে ফারাক্কা পোস্টিং একটা বিশেষ চ্যাপ্টার, আমার বাংলায় প্রথম পোস্টিং, সেই তিন বছর বাংলা কে খুবই কাছ থেকে দেখেছি l ঘেরাও দেখেছি এবং ঘেরাও হয়েছি l কিন্তু চুটিয়ে সেমি আরবান বাংলা উপভোগ করেছি l

ফারাক্কায় প্রথম লিচু বাগানে গাছ থেকে পেড়ে লিচু খাওয়া কিম্বা আমের সময় সদ্য গাছ থেকে নামানো পাকা মালদা আম, সব ঐ টেম্পোরারি ওয়ার্কার দের দৌলতে,ওরা ওদের গ্রামে নিয়ে যেতো l

সে সব গ্রামে গাড়ি ঢোকে না, কাঁচা রাস্তা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে ওদের বাড়ি আর লিচু কিম্বা আম গাছ বাড়ির সামনে, কাছেই পুকুর l

তবে ইলেক্ট্রিসিটি পৌঁছেছে l তখন অবশ্য এখনকার মত বাড়িতে বাড়িতে টিভি ছিল না, হ্যাঁ ট্রানজিস্টরে গান ভেসে আসতো l

আমার বাংলোর দেওয়াল পেরিয়ে রাস্তা গঙ্গার ধার দিয়ে, ফারাক্কা ব্যারেজ থেকে বেরিয়ে গঙ্গা মোহনার দিকে l

বাংলো টা এনটিপিসির টেম্পোরারি টাউনশিপে!

সামনে গার্ড গেটে, ওদের থেকে নানা রকম গুজব আর খবর পেতাম l

আমার পুরানো ব্যাগ টা নিয়ে ছেলেটি কে বললাম চলো ঐ বেঞ্চে বসি, জিগেস করলাম, তোমার নাম?

বরকত,সে বললো l

আমার আব্বু এই ব্যাগটা খুব যত্ন করে রাখতেন l

আমার মন আমাকে ফারাক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল l

সে এক মজার ঘটনা, বরকতের বাবা জাফির প্রায় আমার কাছে আসত, ও কন্ত্রাক্টরি করত l জোয়ান আমার চেয়ে অনেক ছোট, তখনও ওর বিয়ে হয় নি lজাফীর আমাকে বলেছিল সে প্রায় বাংলাদেশে যায়, জিগেস করছিলাম ভিসা কি করে জোগাড় করে ! 

আমাদের ভিসা টিসা লাগেনা,  বাবার হাত ধরে কালিয়াচকে বাজার করতে আসতাম বেড়া পেরিয়ে, এখনও অনেক লোক ওপার থেকে এসে কলিয়াচকে রিক্সা চালিয়ে টাকা কামিয়ে চলে যায়,ওদের বাপ ঠাকুরদা ঐ কাজই করত l

ভাবলাম সত্যিত বেড়া তো পার্টিশনের পরে লেগেছে, ওরা কিন্তু এটা মেনে নিতে পারেনি পেটের দায় l কই পাখি গুলো তো বেশ এদেশ থেকে ওদেশে যায় , ওদের তো কোনও ভিসা লাগেনা, এটা প্রায় সেই রকম ! অনেক বছর পরে আগরতলা যাই, ওখানের বিখ্যাত কালী বাড়ি টিলার ওপরে, সামনে বেড়া আর ওপারে বাংলাদেশের রেলওয়ে লাইন l ওখানেও জানতে পারি যে ওপার থেকে বাংলাদেশী এপারে দিন মজুরি করে বিকেলে ফিরে যায় l এখন অবশ্য সব কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা l

মজা করে জাফির কে বললাম আমাকে একদিন ঐ রাস্তা দিয়ে বাংলাদেশ নিয়ে চল l

আপনি যাবেন,কিন্তু আপনা কে লুঙ্গি ফেজ এসব পরতে হবে, যাতে ওদের সংগে মিশে জান l

ও পরের দিন লুঙ্গি ফেজ নিয়ে হাজির, চলুন এক রত্তিরের তো ব্যাপার l

আমিও লুঙ্গি টুঙ্গি পরে বেরিয়ে পড়লাম, ভাগ্যিস গিন্নি আর ছেলে কলকাতা গেছে!

চড়লাম ওর মোটর সাইকেলের পেছনে, গার্ড কে চোখ টিপে বলালম কারুকে না বলতে! 

দাদু গার্ড ডিউটি তে ছিল, ফোকলা দাঁতে হেঁসে মাথা নাড়লো l

জাফির কে আমি মনে মনে গহর ভাবতাম, শ্রীকান্ত র সেই বন্ধু যে কমললতা কে ভালবাসত আর আমি শ্রীকান্ত আমার প্রিয় চরিত্র, জানি না কতবার শ্রীকান্ত পড়েছি, রোমাঞ্চকর ছন্য ছাড়া জীবন l কমল লতা ছবিতে উত্তম শ্রীকান্ত আর নির্মল কুমার গহর, সুচিত্রা কমল লতা!

বোধ হয় সেই দিন একটু বেপরোয়া হয়ে গেছিলাম, শ্রীকান্তের ভূত আমাকে পে বসেছিল l

জাফির মোটর সাইকেল চালাতে চালাতে মজা করে বললো একটু মেহেন্দি চুলে লাগাতে পারতেন! বেশ লাগছে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি তে l আমি তখন ফ্রেঞ্চ কাট রাখতাম,মা মারা যাবার পর ছেঁটে দিয়েছিলাম l মনে পড়ে গেল মা দশ দিন আমার এখানে কাটিয়ে গেছে, রোজ গঙ্গার ধারে বেড়াতে যেত, ভালই দিনগুলি কাটিয়ে গেছিল!

আমি যদিওবা লুঙ্গি পরেছিলাম কিন্তু ভেতরে প্যান্ট আর প্যান্টের পকেটে আমার নতুন মানি ব্যাগ, কোনো আইডেন্টিটি কার্ড ছিলনা, মনে হয় জাফির পরে ওটা রেখেছিল l আমি নীল রঙের  ফতুয়া পরে ছিলাম!

প্ল্যান অনুযায়ী আমরা কালিয়াচকের একটা চায়ের দোকানে আসি l জাফির বাইকটা পার্ক করে আর আমরা চায়ের দোকানে ঢুকি আর অপেক্ষা করতে থাকি কখন বাংলাদেশীরা ঘর ফেরার জন্য আসবে l কথা ছিল আমরা ওদের সঙ্গে দল বেঁধে যাবো, বিএসএফ এর সংগে একটা সমঝোতা ছিলো l

কিন্তু কিছুক্ষণ পরে দেখি এনটিপিসি তে কর্ম রত এক cisf (Central Industrial Security Force)জোয়ান ঢোকে আর আমাকে স্যালুট দিয়ে বলে স্যার আপনি এখানে l আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলি এই ভাবলাম যদি কিছু বাংলাদেশ থেকে পাচার মাছ পাওয়া যায় l জোয়ান টা সিম্পল টাইপ, বলল স্যার ফারাক্কা বাজারের চেয়ে ভালো মাছ কোথায় পাবেন, গঙ্গার টাটকা মাছ l ও কিন্তু আমার ঐ সাজ দেখে কিছু বললো না, মনে হয় ঐ পরিস্থিতে ওটাই স্বাভাবিক ভেবে!

আমি বললাম ঠিক বলেছো, চলো হে জাফির ফেরা যাক l

আমার সেদিন বাংলাদেশ যাওয়া হলনা l আমি আমার টাকা সমেত মানি ব্যাগ জাফির কে গিফট করি,কমসে কম এতটা পথ তো এলাম আর শুধু 10 কিলোমিটার বাকি ছিল বাংলাদেশ যাওয়ার , কাঁটা তার l

পরে অবশ্য ফারাক্কা থেকে বাংলাদেশের মাটিতে পা দিয়েছিলাম আমদের সেন্ট্রাল গভর্মেন্ট অডিটারদের দৌলতে l ওরা আমাকে অনুরোধ করল বাংলাদেশ বর্ডার দেখাতে l গেলাম ওদের নিয়ে, অডিটের ছেলে গুলো পাঞ্জাবি,ওরা বিএসএফ কে পটালো, বললো ভাই আমদের ঐ সাঁকো টা অব্দি যেতে দাও বাংলাদেশের ভেতরে, আমরা তাহলে চাল মেরে আমাদের দিল্লির বন্ধুদের বলতে পারি যে আমরা বাংলাদেশ ঘুরে এসেছি ! পাঞ্জাবিরা এমনিতে খুব সহজেই বন্ধু হয় যায়,ওরাই আমদের বেশ কিছু ভেতরে নিয়ে গেলো l বর্ডারের গ্রাম যেরকম হয়, খেত, সবুজ সবজি, জলা মাঠ, কিছু ছবির তোলা হলো l ব্যাস, বাংলাদেশ ঘোরা হলো l

আমি ভাবুক হয়ে লেকের ধারে বরকতের সঙ্গে বসে হাতে আমার পুরানো ব্যাগ l

ও আমায় জানালো যে জাফির কোরণায় মারা যায় ও এখন ওর ব্যাবসা চালাবার চেষ্টা করছে l আমি ওকে জিগেস করলাম কোনো পয়সার দরকার আছে, ও বললো না l 

আমি ওকে আমার চেনা ফারাক্কার কিছু কন্ট্রাক্টরের মোবাইল নম্বর দিলাম! মনটা ভরাক্রান্ত হয়েগেলো ভেবে জাফীর আর নেই, ওর হাসি খুশি মুখ চোখের সামনে ভাসতে লাগলো,ওর ভব ঘুরে জীবনের গল্প ছবির মত আমার মনের পর্দায় ভাসতে লাগলো ,আমি আর বরকত লেকের ধারে বসে, কিন্তু আমার মন তখন তিরিশ বছর আগের ফারাক্কায় ঘুর পাক খাচ্ছে l

1 comment:

Sukhen Mukherjee said...

সুন্দর