Tuesday, September 03, 2024

মাটির মানুষ





চরিত্র:


- **কমলবাবু**: পুরুলিয়ার ভালপাহাড়ের বাসিন্দা, যিনি মাটি ও মানুষের সাথে গভীরভাবে যুক্ত।

- **ভাটেল হেমব্রম**: একজন প্রবীণ সাঁওতাল উপজাতি, যিনি 'ডাউজার' হিসেবে পরিচিত, ভূগর্ভস্থ জল খোঁজার বিশেষজ্ঞ।

- **রাজীব**: শহরের বন্ধু, যিনি ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি নিয়ে সন্দিহান।

- **ডেলা হেমব্রম**: একজন তরুণ সাঁওতাল মেয়ে, পর্যবেক্ষক ও কৌতূহলী।

- **মনসারাম কুজুর**: সাঁওতাল উপজাতির আরেকজন প্রবীণ, জ্ঞানী ও ধৈর্যশীল।


---


 দৃশ্য ১: কমলবাবুর আবাস, ভালপাহাড়


কমলবাবু ভালপাহাড়ের ছোট্ট বাড়ির বারান্দায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন, আর সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। আমি এবং আমার স্ত্রী মিষ্টি বাতাসের মাঝে বসে তাঁর গল্প শুনছিলাম। শহরের ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে আমরা এখানে এসেছি।


**আমি**: "কমলবাবু, আপনি আমাদের এই জায়গার অনেক চমকপ্রদ গল্প বলেছেন। কিন্তু সম্প্রতি আমি শুনেছি সাঁওতালরা লাঠি দিয়ে ভূগর্ভস্থ জল খোঁজে। এটা কি সত্যি?"


**কমলবাবু**: (মুচকি হেসে) "হ্যাঁ, এটি একটি প্রাচীন শিল্প। let me share an extraordinary experience I had with the Santhals, particularly with Bhatel Hembram, the oldest dowser among them."


**আমি**: (উত্তেজিত হয়ে) "আচ্ছা, বলুন।"


**কমলবাবু**: "একদিন কলকাতা থেকে আমার বন্ধু রাজীব এসেছিল।"


---

 দৃশ্য ২: পুরুলিয়ার গরম দিন


সেদিন খুব গরম পড়েছিল। মাটির উপরের তাপ এত বেশি ছিল যে  মনে হচ্ছিল চাঁদি ফেটে যাবে। বাপরে বাপ এরকম গরম আগে কখনও দেখি নি l গাছপালা শুকনো এবং ঝুলে পড়েছে। কমলবাবু,রাজীব, ভাটেল, ডেলা, এবং মনসারাম প্রস্তুত হচ্ছিল। ভাটেল একটি Y-আকৃতির লাঠি হাতে নিয়ে দলের সাথে গরম রোদে হাঁটতে শুরু করল।


ডেলা: (ভাটেলের পাশে হাঁটতে হাঁটতে) "দাদু, আপনি কিভাবে জানেন জল কোথায়? এটা কি জাদু?"


ভাটেল: (মৃদু হেসে) "জাদু নয়, নাতনি। এটি এমন একটি দক্ষতা যা আমি আমার বাপ ঠাকুরদা র কাছ থেকে পেয়েছি। লাঠি আমার সাথে কথা বলে।"


মনসারাম: (মাথা নাড়িয়ে) "ভাটেল সবসময় এটি অনুভব করে। তার বাবা-দাদা ও একইভাবে এটি করেছেন। এটি এমন কিছু যা আপনি আপনার হাড়ে অনুভব করেন।"


কমলবাবু: (রাজীবকে বোঝাতে) "রাজীব, দেখ, এখানে মাটি শুকিয়ে গেছে এবং জল খোঁজা অত্যন্ত জরুরি। সাঁওতালরা তাদের জীবন ধারনের জন্য এই প্রাচীন প্রথার উপর নির্ভর করে।"


রাজীব: (সন্দেহভরে) "এবং এই লাঠিটি আসল সম্বল, বিশ্বাস হয় না?"


ভাটেল: (হেসে) "দেখবেন বন্ধু। পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করার নিজস্ব উপায় আছে।"


---


দৃশ্য ৩: অনুসন্ধান শুরু


দলটি নিরলস সূর্যের তাপে হাঁটতে থাকে, মাইলের পর মাইল। Y-আকৃতির লাঠিটি শক্ত হাতে ধরে, ভাটেল মাটির ওপরের সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো পর্যবেক্ষণ করছে। ডেলা তাকে নিবিড়ভাবে দেখছে এবং তার পদক্ষেপগুলি অনুকরণ করছে।


ডেলা: (কমলবাবুকে ফিসফিস করে) "দাদু, আপনি কি মনে করেন আজ জল পাওয়া যাবে?"


কমলবাবু: (মাথায় হাত বুলিয়ে) " হ্যাঁ রে পাগলি,জল পাওয়া গেলে ভাটেল পাবে।"


ভাটেল হঠাৎ থেমে হাত তুলে বলেন, "চুপ, সবাই। আমি শুনতে পাচ্ছি।" দলের সদস্যরা থেমে যায় এবং সব শব্দ স্তব্ধ হয়ে যায়। ভাটেল স্থির হয়ে দাঁড়ান, লাঠিটি মাটির দিকে নিচু হয়ে যায়। হঠাৎ, লাঠিটি যেন একটি জীবন্ত জিনিস, মাটির দিকে সোজা ঝাঁপিয়ে পড়ে!


ভাটেল: (ফোকলা দেঁতো হেঁসে) "এখানে। জল এখানে।"


রাজীব: (আশ্চর্য হয়ে) "আপনি এত নিশ্চিত কীভাবে?"


ভাটেল: (আত্মবিশ্বাসের সাথে) "লাঠি কথা বলেছে। এখানে খোঁড়ো।"


---


 দৃশ্য ৪: খনন


সবাই ভাটেলের দেখানো জায়গা খোঁড়া শুরু করে। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে এবং তাদের ঘাম ঝরছে। ঘণ্টা ঘণ্টা ধরে খনন করা হলেও, কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না।


রাজীব: (হাঁপাতে হাঁপাতে) "আপনি নিশ্চিত, ভাটেল? আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা খনন করছি।"


মনসারাম: (খুঁড়তে হাঁটতে) "ধৈর্য ধরো, রাজীব। পৃথিবী তার গুপ্তধন প্রকাশ করতে সময় নেয়।"


ডেলা: (উৎসাহিত হয়ে) "দাদু কখনো ভুল করেননি।"


হঠাৎ, একজন খননকারীর  চিৎকার।


খননকারী: "জল! জল দেখতে পাচ্ছি!"


দলটি উল্লাসে নেচে উঠলো। জলের একটি ছোট স্রোত গর্তে গড়াতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে আয়তনে বৃদ্ধি পায়।


ভাটেল: (নিঃশব্দে হেসে) "এটা নির্ভর করে কে কত বিশ্বাস নিয়ে জিগেস করছে, তবে পৃথিবী সব সময় দিচ্ছে, আমরা পৃথিবীকে মর্যাদা দি না।"


কমলবাবু: (রাজীবের দিকে ফিরে) "এখন কি তুমি পুরানো পদ্ধতিতে বিশ্বাস করো, বন্ধু?"


রাজীব: (বিস্ময়ে) "আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। এটি অবিশ্বাস্য।"


---


 দৃশ্য ৫: ভালপাহাড়ে ফিরে


দলটি ভালপাহাড়ে ফিরে আসে, ক্লান্ত কিন্তু বিজয়ী। তারা ল্যাম্পের চারপাশে বসে, গল্প ও খাবার ভাগ করে নেয়।


কমলবাবু*: (রাজীবের উদ্দেশে) "এখানেই জীবন। আমাদের প্রবীণদের পুরানো পদ্ধতি ও প্রজ্ঞা আমাদের টিকিয়ে রাখে।"


রাজীব: (চিন্তা করে) "এই ঐতিহ্য থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। এটি হারিয়ে না যায় যেমন আমরা আধুনিকতার চাপে জল ফ্রিজে রাখি।"


ডেলা: (ভাটেলের পাশে বসে) "দাদু, আমাকে লাঠি শুনতে শেখাবে?"


ভাটেল: (ওর মাথায় হাত দেয়) "একদিন হবে। আপাতত, আমাদের উচিত পৃথিবীর কথা শোনা ও সম্মান দেওয়া, গাছপালা বাঁচিয়ে রাখা। তখন জল খোঁজার জন্য এত কষ্ট করতে হবে না।"


মনসারাম: (কাপ তুলে) "ভাটেলের কাছে, জলের ফিসফিসকারী এবং পুরানো পদ্ধতি যা আমাদের গাইড।"


সবাই: (কাপ তুলে) "ভাটেল!"


---


 দৃশ্য ৬: একটি শান্ত প্রতিফলন


রাতে, কমলবাবু এবং রাজীব বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন। 


রাজীব: (নিরবতা ভেঙে) "ধন্যবাদ আমার সাথে শেয়ার করার জন্য, কমলবাবু। এটি একটি অভাবনীয় অভিজ্ঞতা ।"


কমলবাবু: (মাথা নাড়িয়ে) "মাটি অনেক কিছু গোপন রাখে, রাজীব। আর এখানকার মানুষ শুনতে শিখেছে। এটি মনে রাখার মতো একটি পাঠ।"


রাজীব: (মুচকি হেসে) "আমি এটা কখনো ভুলব না।"


রাত গভীর হয়, এবং গ্রামের শব্দগুলি শান্তিপূর্ণ ছন্দে স্থির হয়। পুরুলিয়ার বিস্তীর্ণ আকাশের নীচে, পৃথিবী এবং এর লোকদের জ্ঞান একটি নিরন্তর ফিসফিস রয়ে গেছে, যুগে যুগে তাদের পথ দেখায়।


---


**কমলবাবু** যখন অক্লান্ত ও নিঃস্বার্থভাবে ৩০ লক্ষ গাছ লাগালেন, তখন একটি পুকুর মাঝখানে সৃষ্টি হলো, জলাভাব কিছুটা কমলো এবং হয়তো ডাউজারের আর দরকার পড়ে না l

আজ কমল বাবু নেই কিন্তু ঐ তিরিশ লক্ষ গাছ তাঁর কাজের সাক্ষী l তিনি ঐ তিরিশ লক্ষ গাছ, মাটি, পুকুর এর মধ্যে দিয়ে আমদের মধ্যেই সর্বদা আছেন l জয় বৃক্ষনাথ!

2 comments:

Sabyasachi Chowdhury said...

স্যার, অভিভূত! নিশ্চয় এটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা। অবিশ্বাস্য লাগলেও বিশ্বাস করি। প্রকৃতি চিনতে হলে প্রকৃতির র সঙ্গে একাত্ম হওয়া প্রয়োজন, যেটা ভাটেল প্রকৃতির মধ্যে বড হয়ে শিখেছে। এক নতুন উপলব্ধি। অনেক ধন্যবাদ 🙏

samaranand's take said...

ধন্যবাদ, এই লেখা টা কমল বাবুর স্বরণে লেখা, কমল বাবু কে share করেছিলাম!