কাল টলি ক্লাবে আমার দেখা হয়ে গেল বসন্ত কেবিনের চতুর্থ প্রজন্মের উত্তরসূরির সঙ্গে। বেশ প্রাণবন্ত ছেলেটি, গল্ফ খেলে, আর একসময় ইংল্যান্ডে উইপ্রো-তে কাজ ছেড়ে কলকাতায় ফিরে এসে এখন টিসিএস-এ চাকরি করছে। নিজেকে সে বলল ‘একদম খাঁটি বাঙালি’—বাংলা আর মোহনবাগানকে নিয়ে তার আবেগ চোখে পড়ার মতো। তার কলকাতায় ফেরা আর নিজের শিকড়ে ফিরে আসার সিদ্ধান্তটা আমাকে খুব ছুঁয়ে গেল। আমাদের অনেকের মধ্যেই তো এই টান কাজ করে, না হলে কলকাতায় সেটেল করলাম কেনো।
ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি ফিরে গেলাম ১৯৬০ সালের কলকাতায়—যখন আমি আর আমার মেজো ভাই অমু প্রথম এসেছিলাম এই শহরে। থাকতাম কলেজ স্ট্রিটে গুপ্তকাকুর বাড়িতে। ওনিই প্রথম আমাদের নিয়ে গেলেন বাসন্ত কেবিনে, আর পরিচয় করালেন সেই স্বর্গীয় স্বাদের ঢাকাই পরোটার সঙ্গে। আজও সেই প্রথম কামড়টা মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়—এতটা স্মৃতিময়, এতটা স্বাদে ভরা ছিল সেটা।
এই ছেলেটির সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই বসন্ত কেবিন নিয়ে অনেক কথা হল। ও বলল, এখন কলকাতায় তিনটে শাখা আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "দক্ষিণ কলকাতায় একটা কেন খুলছেন না?" সত্যি কথা বলতে, এই প্রশ্নে আমার একটু স্বার্থও ছিল—নিজের বাড়ির কাছেই যদি পেতাম, মন্দ কী!
ওর উত্তরটা ছিল বেশ ভেবেচিন্তে দেওয়া। বলল, অনেকেই ফ্র্যাঞ্চাইজি অফার নিয়ে এসেছেন, কিন্তু ওদের পরিবার এখনো দ্বিধায় আছে। কারণ? গুণগত মান বজায় রাখা। বলল, “একবার যদি স্বাদ খারাপ হল, তাহলে ঐতিহ্যটাই নষ্ট হয়ে যাবে।” উদাহরণ দিল উত্তর কলকাতার মিত্র ক্যাফের, যারা দক্ষিণে শাখা খুলেছিল। আমি নিজেও গিয়েছি, আর স্বীকার করতেই হবে—সেই পুরনো গন্ধ-স্বাদ-আবেগ কিছুই ছিল না।
প্রশ্ন হলো আজকের দিনে ঐ ঝাঁ চক চক অদ্ভুত সব নামের রেস্তোরাঁ সঙ্গে এই সব পুরোনো কেবিন কম্পিটিশন দিতে পারবে কি, আমাদের প্রজন্ম হয়তো পুরানো স্মৃতির জন্য এখনো ঐ সব কেবিন যাই!
এই কথায় একটা বড় প্রশ্ন উঠে আসে—একই স্বাদ, একই মান, প্রতিদিন, প্রতিটি দোকানে কীভাবে বজায় রাখা যায়? কলকাতায় খাবার তো কেবল ক্ষুধা মেটানোর জিনিস নয়—এটা একটা আবেগ, একটা সংস্কৃতি। বাসন্ত কেবিনের মতো দোকানগুলো বেঁচে আছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সঞ্চিত রেসিপি, অভিজ্ঞতা, আর একধরনের 'ম্যাজিক'-এর উপর ভর করে—যেটা কপি করাটা খুব কঠিন। আমি একই প্রশ্ন করেছিলাম অনাদি কেবিনের মালিক কে,একই উত্তর l
তবে বড় বড় আন্তর্জাতিক চেন যেমন কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডস বা পিজ্জা হাট—তারা তো পারছে! কলকাতা থেকে ক্যানসাস—একইরকম বার্গার বা চিকেন, কোনো ফারাক নেই। কীভাবে সম্ভব?
এর রহস্য লুকিয়ে আছে ওদের কঠোর ও সুসংগঠিত সাপ্লাই চেনে। তারা কাঁচামাল সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট, অনুমোদিত জায়গা থেকে—যেখানে মান বজায় রাখার নিয়ম খুব কড়া। সবকিছুই আধা-প্রস্তুত অবস্থায় প্রস্তুত হয়—যেমন কাটা আলু বা ম্যারিনেট করা মাংস—যাতে রান্নায় ভিন্নতা না আসে। ঠান্ডা চেন (cold chain) ব্যবস্থায় জিনিসপত্র তাজা থাকে, আর নির্দিষ্ট রেসিপি, মেশিনে রান্না—সব মিলিয়ে একরকম স্বাদ নিশ্চিত করে। উপরন্তু নিয়মিত অডিট আর প্রশিক্ষণ তো আছেই।
লোকাল দোকানগুলোর ক্ষেত্রে এই ধরণের বড়সড় পরিকাঠামো থাকে না। সেখানে রোজ বাজার, হস্তশিল্পের মতো রাঁধার কৌশল, আর অনেকটা ‘মানুষের উপর নির্ভরতা’ কাজ করে। ফলে একই স্বাদ প্রতিদিন পাওয়া খুব চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে।
টলি ক্লাব থেকে বেরিয়ে আসার সময় ছেলেটির প্রতি একটা শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হল—নিজের পারিবারিক ঐতিহ্যকে ও খুব যত্ন করে আগলে রেখেছে। বাসন্ত কেবিন এখনো কলকাতার এক রত্ন, এক স্বাদের স্মৃতির ধন। হয়তো দক্ষিণ কলকাতা-কে আর একটু অপেক্ষা করতেই হবে। কিন্তু তাতে কী—ঢাকাই পরোটার টানে আমি আজও উত্তর কলকাতায় যেতে রাজি!
পাদটীকা: আন্তর্জাতিক ফাস্টফুড চেন কীভাবে সাপ্লাই চেন বজায় রাখে
কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডস বা পিজ্জা হাট-এর মতো আন্তর্জাতিক চেনগুলোর মূল শক্তি তাদের নিয়ন্ত্রিত সাপ্লাই চেন। তারা নির্দিষ্ট ও অনুমোদিত সাপ্লায়ার থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে, যেগুলি উচ্চমান বজায় রাখে। এই কাঁচামাল আধা-প্রস্তুত অবস্থায় প্রস্তুত হয় (যেমন কাটা আলু, ম্যারিনেট করা মাংস), যাতে স্বাদের ভিন্নতা না আসে। ঠান্ডা চেন ব্যবস্থায় জিনিসপত্র সঠিক তাপমাত্রায় পৌঁছে যায়। রান্নার জন্য নির্দিষ্ট রেসিপি ও অটোমেটেড যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়, যাতে মানবিক ভুলের সুযোগ কমে যায়। উপরন্তু নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও গুণমান পরীক্ষার মাধ্যমে একই স্বাদ ও মান বজায় রাখা সম্ভব হয়। এই ব্যবস্থাগুলো সাধারণত ছোট, স্থানীয় দোকানগুলির ক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকে—ফলে সেখানে একক গুণমান বজায় রাখা অনেক বেশি কঠিন।