হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধনের পিজ্জা-
হর্ষবর্ধনের মাথায় নতুন ভূত চাপল—"ইটালিয়ান কালচার অ্যাডপ্ট করব!" তাই সকালবেলা গোবর্ধনকে ডেকে বললেন,
—“গোবু, আজ আর পরোটা-কচুরি নয়। আজ খাব পিৎজা!”
গোবর্ধন চশমার ওপারে চোখ কুঁচকে বলল,
—“পিৎজা মানে যে ওই রুটির ওপরে কাঁচা সবজি ফেলে দেয়?”
হর্ষবর্ধন গম্ভীর হয়ে বললেন,
—“তোর মতো গ্রাম্য মনোভাব নিয়ে কোথাও পৌঁছানো যাবে না গোবু! এটাই হল আজকের গ্লোবাল গ্যাস্ট্রোনমি!”
ঠিক হলো, যাবে ডমিনোজ—গলফ গ্রীন শাখা, যেটার সামনে হর্ষবর্ধন প্রায়ই বলতেন, “এটা কি ডোমিনো ইলেভেনের কোনো এক্সটেনশন?”
দু'জনে ঢুকল দোকানে। ভেতরে এয়ার কন্ডিশনের শীতলতায় গোবর্ধনের নাক হাঁচির ফোয়ারা ছাড়ল।
কাউন্টারে এসে হর্ষবর্ধন বললেন,
—“আমাদের একটা পিৎজা দিতে হবে... কিন্তু সেইটা যেন... যাকে বলে একদম ঐতিহাসিক হয়!”
কর্মচারী হেসে বললেন, “সার, কোন বেস নেবেন? হ্যান্ড টসড, প্যান, থিন ক্রাস্ট?”
হর্ষবর্ধন এক মুহূর্ত থেমে, গম্ভীর গলায় বললেন,
—“আমরা হ্যান্ড টস করেই খাই সাধারণত, পিঠা-পুলি... তবে আপ্নারা যেটা বেশি দামী, সেটা দিন।”
গোবর্ধন ফিসফিস করে বলল,
—“ভাই, প্যান তো শুনেছি বাসন হয়, সেটা কি খাব?”
এরপর এল উপাদানের পর্ব।
কর্মচারী: “স্যার, টপিংস কী কী নেবেন? টমেটো, ক্যাপসিকাম, জালাপেনোস, সুইট কর্ন—”
হর্ষবর্ধন সঙ্গে সঙ্গে বললেন,
—“টমেটো তো থাকে বাঙালির রক্তে! সেটা রাখুন। ক্যাপসিকামটা কি শিমের কাকা গোবু?”
গোবর্ধন মাথা চুলকে বলল,
—“জালাপেনো কি জ্বালাপোড়া?”
—“তা’ই তো হবে। গরম খাবার খাওয়া তো শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। সেটা বাদ দিন। কর্ন রাখুন, আমরা তো চাষির বংশধর!”
হর্ষবর্ধন তখন পনির আর চিজ নিয়ে সন্দিগ্ধ।
—“চিজ আর পনির কি এক জিনিস? আরেকটা দিলে কি দাম কমবে?”
কর্মচারী বিরক্ত হয়ে বলল, “স্যার, ওগুলো আলাদা নয়, একই ক্যাটাগরির। চিজ হবে নাকি চিজ বার্স্ট?”
—“চিজ বার্স্ট মানে? ওটা কি খাবার না বোমা?”
গোবর্ধন সাহস করে বলল,
—“ভাই, বার্স্ট মানে ফেটে যাবে! এরপর যদি পেটও বার্স্ট করে—?”
অবশেষে কোনোরকমে একটা পিজ্জা অর্ডার হয়ে গেল। হর্ষবর্ধন চেয়ার টেনে বসে বললেন,
—“গোবু, দেখিস... আজকের দিনে আমরা ইতিহাস তৈরি করলাম। ভবিষ্যতে বাঙালি বলবে—পিজ্জার শুরু হয়েছিল হর্ষবর্ধন গোবর্ধনের হাত ধরে!”
গোবর্ধন এক টুকরো পিজ্জা মুখে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
—“আহারে, এর থেকে মায়ের করে দেওয়া লুচি-আলুর দমই ভালো ছিল...”
পাশের এক টেবিল থেকে কারো আওয়াজ ভেসে এলো—“ওই যে, আবার এসেছে সেই দুই পিজ্জা-পণ্ডিত
হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধনের পিজ্জা-প্রথমার্পণ (পর্ব ২)
“ফ্লেকস, ফর্ক আর ফ্যাশনেবল খাদ্যবিধি”
পিজ্জা এসে গেছে। গোলাকৃতি এক অচেনা বস্তু। তার ওপর নানা রঙের সবজি, গলানো চিজ, আর একপাশে দুটো ছোট কৌটো—একটায় লাল গুঁড়ো আরেকটায় কাঁচা কাঁচা জিনিস!
গোবর্ধন ফিসফিস করে বলল,
—“ভাই, ওগুলো কি? এই লালটা কি বেদানা গুঁড়ো?”
হর্ষবর্ধন চোখ ছোট করে বললেন,
—“না রে গোবু, এগুলো হচ্ছে কালচারের কামান... এগুলোর নাম চিলি ফ্লেক্স আর অরিগ্যানো। খেয়ে দেখিস, মুখ দিয়ে ভাষা বেরোবে না!”
গোবর্ধন চিলি ফ্লেক্স এক চিমটে করে দিল পিজ্জার ওপরে। তারপর এক কামড় দিয়েই চিৎকার—
—“হাই হাই! মুখে আগুন! এ যে একেবারে কাঁচা মরিচের পিশে দেওয়া অবতার!”
হর্ষবর্ধন গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন,
—“বিদেশি খাবারে কষ্ট একটু হবেই। না জ্বললে পেট পরিষ্কার হয় কী করে?”
এরপর এল কাঁটা-চামচ প্রসঙ্গ।
ডোমিনোজের ছেলে politely দিয়ে গেল ফর্ক আর নাইফ।
গোবর্ধন কাঁটা চামচ হাতে নিয়ে বলল,
—“ভাই, এটা দিয়ে তো ইলিশ কাটা যায় না, পিজ্জা কাটা যাবে?”
হর্ষবর্ধন দার্শনিকের ভঙ্গিতে বললেন,
—“ইহা কেবল ভোজন নয় গোবু, এটি একটি আর্ট। পশ্চিমা সভ্যতা বলে, খাদ্য গ্রহণও একটি পরিশীলিত পর্ব। খেতে হবে ঠিকভাবে। কোণ ৪৫ ডিগ্রিতে নাইফ, ৩০ ডিগ্রিতে ফর্ক। অ্যাংগেল বজায় রাখিস।”
গোবর্ধন তার মুখে একচিমটে পিজ্জা নিয়ে বলল,
—“আমার অ্যাংগেলে তো পিজ্জা ঢুকতেই চাইছে না! আমি বরং হাতেই খাই।”
—“না না! হাত দিয়ে খেলে পাশের টেবিলের লোক ভাববে আমরা বন থেকে এলাম। এখন গ্লোবালিজড সভ্যতায় হাত দেওয়া মানেই অপরাধ!”
পাশের টেবিলের এক বাচ্চা তখন পিজ্জা তুলে খাচ্ছে হাতে। গোবর্ধন সেই দৃশ্য দেখে বলল,
—“ওটা কি তাহলে ছোটখাটো অপরাধ?”
হর্ষবর্ধন তখনও ছুরি-কাঁটা হাতে ব্যস্ত। পিজ্জা কাটতে গিয়ে প্লেট থেকে স্লাইস পিছলে পাশের চেয়ারে গিয়ে পড়ল। সে চেয়ারে বসে ছিলেন এক গুরুগম্ভীর সাহেবসুলভ ব্যক্তি, যিনি আচমকা চিৎকার করে উঠলেন,
—“What the hell!”
হর্ষবর্ধন বললেন,
—“Sir, this is not hell, this is Harshabardhan. And that is our pizza. Sorry for the missile.”
শেষে সব হার মেনে দু’জনেই হাত দিয়ে খেতে শুরু করলেন। গালভরা চিজ, জ্বলন্ত ফ্লেক্স, আর ভিতরে তপ্ত টমেটোতে গোবর্ধন জিভ কামড়ে বলল—
—“এই জিনিস খেতে গিয়ে যদি ভাষা হারাই, তখন কী বলবি ভাই?”
হর্ষবর্ধন অট্টহাসি হেসে বললেন,
—“তখন বলব—তুই এখন আন্তর্জাতিক খাদ্যবর্জিত বাঙালি!”
শেষে দুই ভাই বলল,
—“আগামীবার পিজ্জা নয় গোবু, ফিরব ভেজিটেবল কাটলেট আর মোগলাই পরোটা-তেই!”
No comments:
Post a Comment