Monday, May 19, 2025

শ্রীকান্তর রাত বেরাতে ভূতের গল্পো



---

**শ্রীকান্তর রাত-বেরাতের ভূতের গল্প**

কলকাতার এক ঝড়ঝাপটা রাতে, যখন আকাশ গর্জাচ্ছে যেন কোনো রাগী কবি আর বৃষ্টি পড়ছে রবীন্দ্র নাথের কবিতার মতো উন্মাদ হয়ে, শ্রীকান্ত—হ্যাঁ, আমাদের সেই শ্রীকান্ত, এখন কীভাবে যেন টালিগঞ্জের এক পশ ফ্ল্যাটের চতুর্থ তলায় মধ্যবয়সী ব্যাচেলর—বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছিল। দিনটা ছিল হাড়ভাঙা ক্লান্তির। দূর-সম্পর্কের এক কাজিনের বিয়ের রিসেপশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা খোশগল্প, তৈলাক্ত বিরিয়ানি আর মাসিদের একই প্রশ্ন, “শ্রীকান্ত, তোমার বিয়ে কবে?” দুপুরে একটা ঘুম দিয়ে কোনোমতে নিজেকে সামলেছিল, কিন্তু এখন, মাঝরাতে, ঘুম তার কাছে অন্নদাদিদির ছেলেবেলার স্মৃতির মতোই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

বাইরে বৃষ্টি ঝমঝম, বজ্রপাত যেন ইন্দ্রনাথের পুরোনো সাহসী কথা। শ্রীকান্তর মন চলে গেল সেই দূরের রাতে, যখন সে আর ইন্দ্রনাথ নৌকো চালিয়ে অন্নদাদিদির বাড়ির দিকে যাচ্ছিল, নদীর ধারে ভূতের গল্পে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। স্মৃতিটা তাকে কাঁপিয়ে দিল, পাতলা কম্বলের তলায়। “কলকাতার এই ফ্ল্যাটে একটা ভূত থাকলে মন্দ হতো না,” সে হেসে বলল, ভাবল একটা ভূত হয়তো তার এই চা-আর-পুরোনো-উপন্যাসের জীবনে একটু মশলা আনত।

ঠিক যখন তার চোখ ঘুমের কিনারায় ঝাপসা হচ্ছিল, *ডিং-ডং!* কলিং বেল বেজে উঠল, তীক্ষ্ণ আর অসময়ে, ঝড়ের শব্দ ছিঁড়ে। শ্রীকান্ত ধড়মড়িয়ে উঠে বসল, বুক ঢিপঢিপ। “কে রে? রাত একটার সময়?” সে গজগজ করল। কমপ্লেক্সে ডেলিভারি বয়দের রাত এগারোটার পর ঢোকা বারণ, আর গার্ড, নিয়মের পাহাড়, সুইগির ছেলেকে লিফটে তুলতেই পারে না—বাঘের সঙ্গে লড়াই করা সহজ। “ভূত নাকি?” সে ফিসফিস করে বলল, অর্ধেক হেসে, অর্ধেক ভয়ে, বাইরে বজ্রপাত যেন তার কথায় সায় দিল।

শ্রীকান্ত, তার মলিন গেঞ্জি আর ডোরাকাটা লুঙ্গিতে, বিছানা থেকে নিজেকে টেনে নামাল, শরীর যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে এটা কোনো ভাঙা নৌকো। খাওয়ার ঘর পেরিয়ে, যেখানে বিয়ের মিষ্টির থালা এখনো ছড়ানো, সে ড্রয়িং রুমে পৌঁছল। দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের ফ্রেম করা ছবি যেন তার এলোমেলো চেহারা দেখে বিচার করছে। দরজায় পৌঁছে সে পিপহোলে চোখ রাখল। অন্ধকার। কেউ নেই। তার মন ছুটল কমপ্লেক্সের ইতিহাসে—এটা একটা পুরোনো ব্রিটিশ আমলের কবরখানার কাছে তৈরি, যদিও এখন সেটা গলফ কোর্সের অংশ। “ফিরিঙ্গির ভূত?” সে ভাবল, কল্পনায় এক ফিরিঙ্গি সাহেব, পিথ হেলমেট পরে চা দাবি করছে।

হাতের কাছে একটা গোটানো *আনন্দবাজার পত্রিকা* ছাড়া আর কোনো অস্ত্র না পেয়ে, সে দরজাটা ফাঁক করল, হৃৎপিণ্ড বৃষ্টির চেয়ে জোরে বাজছে। করিডর ফাঁকা, টিউবলাইট ঝিকমিক করছে যেন কোনো সস্তা হরর ফিল্ম। সে মাথা বাড়িয়ে বাঁদিকে তাকাল, আর থমকে গেল। একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে, হাত বাঁধা, ভঙ্গিটা যেন স্কুলের কড়া হেডমিস্ট্রেসের। চশমা ছাড়া, শ্রীকান্ত চোখ কুঁচকে তাকাল, ভাবল এবার সত্যি ভূত। কিন্তু তখনই একটা তীক্ষ্ণ, বিরক্ত গলা ভেসে এল: “শ্রীকান্তবাবু, আপনার বাথরুমের পাইপ ফেটেছে! জল ঝরঝর করে বেরোচ্ছে, আমার ফ্ল্যাটের ড্রেন দিয়ে শব্দ করে আমি ঘুমোতে পারছি না!”

এ ছিলেন মিসেস চ্যাটার্জি, তৃতীয় তলার প্রতিবেশী, অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, যিনি রেসিডেন্টস ওয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পার্কিং নিয়ে সবাইকে ত্রাসের মুখে ফেলেন। ফুলছাপ নাইটগাউনে, চুলের খোঁপা তার মেজাজের মতোই শক্ত, তিনি ভূতের চেয়ে কম কিছু ছিলেন না। “এখুনি ঠিক করুন!” বলে তিনি ধমকে চলে গেলেন, তার চটির শব্দ যেন ছোট ছোট বজ্রপাত।

শ্রীকান্ত, এবার পুরো জেগে, বাথরুমে ছুটল। সত্যি, একটা পাইপ ফেটে জল বেরোচ্ছে যেন মৌসুমী নদী, তার দুর্ভাগ্যের ওপর হাসছে। সে মেন ট্যাপ বন্ধ করতে গিয়ে লড়াই করল, বাড়িওয়ালা, প্লাম্বার আর নিজের ভাগ্যকে গাল দিল। জল বন্ধ হওয়ার পর তার লুঙ্গি ভিজে চুপচুপে, আর ফ্ল্যাটটা যেন মাছের বাজারের সেট।

ক্লান্ত হয়ে সে সোফায় ধপাস করে বসল, বাইরে ঝড় এখনো গর্জাচ্ছে। “ইন্দ্রনাথ থাকলে একটু হাসত,” সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, কল্পনায় তার পুরোনো বন্ধু তার এই দশা দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। হেসে সে ভাবল, ইন্দ্রনাথ হলে পাইপটাকে চ্যালেঞ্জ করত আবার ফাটতে। কিন্তু হাসতে হাসতেই আবার একটা ফ্যাকাশে *ডিং-ডং*। শ্রীকান্ত চমকে উঠল। ঘড়িতে রাত দুটো। মিসেস চ্যাটার্জি ফিরবেন না, তবে? সে দরজার দিকে এগোল, পিপহোলে আবার শুধু ঝিকমিকে করিডর। কেউ নেই। “এবার সত্যি ভূত,” সে ফিসফিস করল, পত্রিকাটা আরো শক্ত করে ধরে।

তখনই চোখে পড়ল—দরজার তলায় একটা ভেজা, ছোট্ট কাগজ ঢুকানো। কাঁপা হাতে সে তুলে নিল। ঝাপসা কালিতে লেখা: “শ্রীকান্ত, পাইপ ঠিক করার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু লিফটের কাছে একটা আয়নার পাশে খুব শব্দ হচ্ছে। দেখে এসো। –ইন্দ্রনাথ।”

শ্রীকান্তর চোয়াল ঝুলে গেল। ইন্দ্রনাথ? তার ছেলেবেলার বন্ধু, যে কত বছর আগে হারিয়ে গেছে, এখন কলকাতার হাইরাইজে চিঠি লিখছে? সে নার্ভাস হেসে বলল, “মিসেস চ্যাটার্জির হাতের লেখা নাকি?” কিন্তু কাগজের উড়ন্ত হস্তাক্ষর ছিল ইন্দ্রনাথের বেপরোয়া মেজাজের মতো। সে দরজা খুলে ফাঁকা করিডরে তাকাল, দূরে লিফটটা মৃদু আলোয় জ্বলছে। কোথা থেকে যেন নৌকোর ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ ভেসে আসছে।

“যাক, কাল দেখা যাবে,” বলে শ্রীকান্ত দরজা বন্ধ করে কম্বলের তলায় ঢুকল, পত্রিকাটা এখনো হাতে। ঘুমের মধ্যে সে যেন শুনল, ঝড়ের মধ্যে দাঁড়ের ছপছপ আর ইন্দ্রনাথের ফিসফিস, “চল, শ্রীকান্ত, অন্নদাদিদির বাড়ি যাই!”

পরদিন সকালে চিঠিটা উধাও। লিফট নিঃশব্দ, পাইপ ঠিক, আর মিসেস চ্যাটার্জি, জিজ্ঞেস করায়, বললেন তিনি কোনো ইন্দ্রনাথের নাম শোনেননি। কিন্তু শ্রীকান্ত, চা খেতে খেতে, মুচকি হাসল। “ভূত, না ভাই, তোর এই ডেয়ারডেভিল স্টাইল কিছুদিন ভুলব না,” বলে সে চায়ের কাপ তুলে ঝড়ের, নদীর, আর সেই রহস্যের উদ্দেশে তুলে ধরল, যা তার রাতকে একটা বলার মতো গল্প করে দিল।

---


No comments: